নয়ামাধ্যম যােগাযােগের বর্তমান দুনিয়ায় তথ্যায়ন ও ধারণায়নের একটি কার্যকর ও স্বীকৃত পন্থা হলাে গণমাধ্যমে রিপাের্টিং তথা সাংবাদিকতা। একুশ শতকের সংবাদমাধ্যম রিপাের্টিং প্রবণতা এবং সংবাদ, সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক – এসব বিষয়ের প্রাসঙ্গিক ধ্যান-ধারণা নিয়েই তাই বর্তমান গ্রন্থের প্রারম্ভিক অধ্যায়ের অবতারণা।
উদ্ভব ও বিকাশের কালপরিক্রমায় আমাদের দেশের সাংবাদিকতায় একুশ শতকের আগ পর্যন্ত মূলত সংবাদপত্রকেন্দ্রিক রিপাের্টিং তৎপরতাই চোখে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে এদেশে সাংবাদিকতায় যারা অগ্রপথিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের অধিকাংশই সংবাদপত্রকেন্দ্রিক রিপাের্টিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়েই এ পর্যন্ত পথ হেঁটেছেন।
তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ও উৎকর্ষের সুবাদে একুশ শতকে এসে দ্রুতই বদলে যাচ্ছে মানব সভ্যতার দৃশ্যপট। নতুন সহস্রাব্দের সাংবাদিকতার ধ্যানধারণা এবং চর্চার কলাকৌশলগুলােতেও তাই লক্ষ করা যায় নানা পরিবর্তন।
সাম্প্রতিককালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নতুন নতুন শাখায় রিপাের্টিং করার অবারিত সুযােগ-সুবিধা ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নিউ মিডিয়া’, ‘নিউ জার্নালিজম’, ‘সাইবার বা অনলাইন জার্নালিজম’, ‘পাবলিক জার্নালিজম’ কিংবা ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ – আধুনিক সংবাদমাধ্যম জগতের এসব নিত্য পরিভাষার সঙ্গে আমরা দিনে দিনে কম-বেশি পরিচিত হয়ে উঠছি।
‘তথ্য-সমাজ যুগের নাগরিক হিসেবে আমরা তাই গভীর আগ্রহ ও উৎসাহের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, সংবাদক্ষেত্রের স্টাফ কিংবা সংবাদমাধ্যমের নিয়ােগপ্রাপ্ত নিয়মিত সংবাদকর্মী না হয়েও এখন সচ্ছন্দে সাংবাদিকতা করছে বহু মানুষ।
ইন্টারনেট ব্লগাররা ইতােমধ্যে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ‘ব্লগ-জার্নালিজম’ নামে নতুন এক ধরনের সাংবাদিকতার সূচনা করেছেন যা এযাবৎকালের প্রচলিত সাংবাদিকতার সকল নিয়ম-কানুন ও কলাকৌশলকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। ওয়েবমাধ্যম নির্ভর এই ‘ব্লগ-জার্নালিজম’ নাগরিকদের তথ্যক্ষেত্রে প্রবেশে তথা তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতাকে এমন এক মাত্রা দিয়েছে যা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত প্রবণতাকে রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে।
সর্বাধুনিক তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তি সংবাদপত্র তথা ‘প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে আমূলে পাল্টে দিয়েছে। আর তাই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিভাজন-রেখাটি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
তথ্য-প্রযুক্তির অত্যাধুনিক সব সুযােগ-সুবিধা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে একটি সংবাদপত্র এখন শতভাগ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে আত্মপ্রকাশের বাস্তবতা অর্জন করেছে। সংগত কারণে সাংবাদিকতার সনাতনী ধ্যান-ধারণা বদলে যাচ্ছে এবং দিনে দিনে পার্থক্য ঘুচে যাচ্ছে মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও উপস্থাপনাগত কার্যক্রমের নানা কৌশলগত আঙ্গিকের মধ্যে।
বিগত শতকের সংবাদ রিপাের্টিং কার্যক্রম আবর্তিত ছিল কাগজ, কলম, নােটবুক আর ম্যানুয়াল ক্যামেরানির্ভর। একুশ শতকে এসে তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে সেই রিপাের্টিং কার্যক্রম দ্রুতই বদলে গেছে। কাগজ, কলম, নােট-প্যাড আর সনাতনী ম্যানুয়াল ক্যামেরার বদলে তা হয়ে উঠছে ল্যাপটপ-কম্পিউটার (ডিজিটাল নােটবুক), ডিজিটাল ক্যামেরা, এমনকি একের পর এক নয়া প্রজন্মের সেলফোন তথা ‘মাল্টিমিডিয়া-ডিভাইস সম্বলিত তথ্য ও যােগাযােগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মাধ্যমনির্ভর।
আর তাই পরিবর্তিত বিশ্বের ‘তথ্য-সমাজ জীবনের কাগজছাপাখানাহীন অনলাইন সংবাদপাের্টালের কোনাে জুড়ি নেই আজ। বলা হয়ে থাকে, সাংবাদিকতার বর্তমান যুগ ‘মেড জার্নালিস্টদের যুগ। সংগত কারণে এ যুগে সাংবাদিক হওয়া জন্মগতভাবে পাওয়া যােগ্যতাবাহক সহজাত কোনাে গুণের অধিকারী হওয়ার মতাে কিছু নয়; বরং তা বহুলাংশেই অর্জিত।
অর্থাৎ এ যুগে সাংবাদিক হতে গেলে প্রথমে তাকে আত্মপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে; অতঃপর, তাকে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকের বিষয়ভিত্তিক ধ্যান-ধারণা অর্জনে যথেষ্ট যত্নবান ও মনােযােগী হতে হবে। পর্যায়ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আয়ত্ত করে ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করে ধাপে ধাপে তাকে এগিয়ে যেতে হবে কাক্ষিত লক্ষ্যে।
কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে সাংবাদিকতার চর্চা আবর্তিত হয়েছে মূলত বরন জার্নালিস্টদের তত্ত্বাবধানে। সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গঠনের ঐতিহাসিক প্রবণতা পর্যালােচনা করলে আমরা লক্ষ করি, বহু গুণ ও যােগ্যতার ধারক বা বাহকরূপে জন্মগত প্রতিভা নিয়েই যেন বিগত শতকের এক একজন সাংবাদিক মহিরুহ হিসেবে আপন ভূবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
সাংবাদিকতার ইতিহাসে পথিকৃৎ সাংবাদিক হিসেবে আজও তারা আপন মহিমায় ভাস্বর। আমাদের দেশে এতকাল ফোন, ফ্যাক্স আর ডাক বিভাগের নির্ভরতা ও বিড়ম্বনা মেনে নিয়েই গ্রামীণ বা আঞ্চলিক সংবাদদাতাদের পাঠানাে সংবাদ সংগ্রহের ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হতাে।
কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে; এখন কী শহর, কী গ্রাম – সর্বত্রই সাংবাদিকের জীবনে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুযােগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক টেলিযােগাযােগসহ ওয়েবনির্ভর বহুমাধ্যম যােগাযােগ ব্যবস্থা।
ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সেলফোনের মাধ্যমে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই এখন কোনাে ঘটনার তথ্য ও ছবি গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে পৃথিবীর যেকোনাে প্রান্তে পাঠানাে সম্ভব হচ্ছে। একথা আজ তাই নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এ যুগের দক্ষ ও স্মার্ট সাংবাদিকের হাতে উঠে এসেছে অত্যাধুনিক সব রিপাের্টিং মাধ্যম ও যন্ত্রোপকরণ, যেমন: ডিজিটাল নােটবুক-ল্যাপটপ, পকেট পিসি-ট্যাব এবং ডিজিটাল যুক্ত বিবিধ মাধ্যম-উপকরণসহ অবাক করা যত মাল্টিমিডিয়া ডিভাইস।
ইতােমধ্যেই এসব তথ্যমাধ্যম ও যন্ত্রোপকরণ প্রচলতি যােগাযোেগ উপকরণ, অর্থাৎ ফোন-ফ্যাক্সটেলিফোন-এর সনাতনী জায়গাটিকে কয়েক প্রজন্ম এগিয়ে নিয়ে গড়ে তুলেছে ওয়েবক্ষেত্রনির্ভর বৈশ্বিক এক স্বতঃশ্চল নেটওয়ার্ক।
মাধ্যম পরিবর্তনে বিশ্ববীক্ষণ অভিজ্ঞতার আলােকে বলা যায়, বিশ্বের অপরাপর অংশের সঙ্গে স্যাটেলাইট, ওয়াইফাই কিংবা ফাইবার অপটিক্যাল যােগাযােগ ব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদ সংযুক্ত হলে বর্তমান ডিজিটাল যুগের সুপরিসর ‘ইলেকট্রনিক সাংবাদিকতার পাশাপাশি অপার সম্ভাবনাময় ওয়েবভিত্তিক নাগরিক সাংবাদিকতায়ও আমরা ক্যারিয়ার গঠনের সুযােগ হিসেবে সফলভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হব।
সংগৃহিত