আফগান শাসন ও বারােভূঁইয়া (১৫৩৮ – ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ)।
১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান হলে একে একে বিদেশি শক্তিসমূহ গ্রাস করতে থাকে বাংলাকে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন অল্প কিছুকাল বাংলার রাজধানীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আফগান নেতা শের শাহের কাছে পরাজয় মানতে হয়। বাংলা ও বিহার সরাসরি চলে আসে আফগানদের হাতে।
আফগানদের দুই শাখা-শূর আফগান ও কররানি আফগানরা বেশ কিছুকাল বাংলা শাসন করেন। শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আকবর আফগানদের হাত থেকে বাংলার ক্ষমতা কেড়ে নেন। রাজধানী দখল করলেও মুঘলরা বাংলার অভ্যন্তরে অনেক দিন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এ সময় বাংলায় অনেক বড় বড় স্বাধীন জমিদার ছিলেন। বারােভূঁইয়া’ নামে পরিচিত এ সকল জমিদার মুঘলদের অধিকার মেনে নেননি। সম্রাট আকবরের সময় মুঘল সুবাদারগণ বারােভূঁইয়াদের দমন করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। বারভূঁইয়াদের দমন করা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে।
আফগান শাসন
মুঘল সম্রাট বাবর ও তাঁর পুত্র হুমায়ুন হুসেন শাহি যুগের শেষ দিক থেকেই চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে মুঘল অধিকারে নিয়ে আসতে। কিন্তু আফগানদের কারণে মুঘলদের এ উদ্দেশ্য প্রথম দিকে সফল হয়নি। আফগান নেতা শের খান শূরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সম্রাট হুমায়ুন। শের খানের পিতা হাসান খান শূর বিহারে অবস্থিত সাসারাম অঞ্চলের জায়গিরদার ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি জায়গিরদার হিসেবে নিয়ােগ লাভ করেন।
এ সময় বিহারের জায়গিরদার জালাল খান নাবালক বলে তার অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শের খান। সমগ্র ভারতের অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন ছিল শের খানের । তাই গােপনে তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। এ লক্ষ্যে অল্প সময়ের মধ্যে শের খান শক্তিশালী চুনার দুর্গ ও বিহার অধিকার করেন। তিনি ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দুইবার বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। এবার সতর্ক হন দিল্লির মুঘল সম্রাট হুমায়ুন । তিনি শের খানের পিছু ধাওয়া করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে নেন।
গৌড়ের চমৎকার প্রাসাদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন এর নামকরণ করেন জান্নাতবাদ। সম্রাট গৌড়ে ৬ মাস আমােদ-ফুর্তিতে গা ভাসিয়ে দেন। এ সুযােগে নিজের শক্তি বাড়াতে থাকেন শের খান। দিল্লি থেকে খবর আসে হুমায়ুনের সম্ভাই হিন্দাল সিংহাসন দখল করার ষড়যন্ত্র করছেন। এ খবর পেয়ে হুমায়ুন দিল্লির দিকে যাত্রা করেন। এ সুযােগ কাজে লাগান শের খান। তিনি ওঁত পেতে থাকেন বক্সারের নিকট চৌসা নাম স্থানে। গঙ্গা নদীর তীরে এ স্থানে হুমায়ুন পৌছালে শের খান তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
অপ্রস্তুত হুমায়ুন পরাজিত হন (১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের খান ‘শের শাহ’ উপাধি নেন। তিনি নিজেকে বিহারের স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘােষণা করেন। এবার বাংলার দিকে দৃষ্টি দেন তিনি। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল শাসনকর্তা আলী কুলিকে * পরাজিত করে তিনি বাংলা দখল করেন। এ বছরই তিনি হুমায়ুনকে কনৌজের নিকট বিলগ্রামের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। এভাবে দীর্ঘদিন পর বাংলা আবার দিল্লির শাসনে চলে আসে। চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ শের শাহের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। শের শাহ শূর বংশের বলে এ সময়ের বাংলার শাসন ছিল শূর আফগান বংশের শাসন।
শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ইসলাম খান’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি আট বছর (১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন। কিন্তু ইসলাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র ফিরােজ খানের সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গে শূর বংশের মধ্যে দলাদলি শুরু হয় । শের খানের ভাগ্নে মুবারিজ খান ফিরােজ খানকে হত্যা করে মুহম্মদ আদিল’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাবলি থেকে এ সময় বাংলা বিচ্ছিন্ন ছিল না।
তাই ইসলাম খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার আফগান শাসক মুহম্মদ খান শূর স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। উপাধি ধারণ করেন মুহম্মদ শাহ শূর। এ সময় থেকে পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত বাংলা স্বাধীন ছিল। মুহম্মদ শাহ নূর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ আদিল শাহ নূরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। তিনি জৌনপুর জয় করে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মুহম্মদ শাহ নূর নিহত হলে দিল্লির বাদশাহ আদিল শাহ শাহবাজ খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মুহম্মদ শাহের পুত্র খিজির খান তখন এলাহাবাদে অবস্থান করছিলেন।
পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ’ উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘােষণা করেন। কিছুদিন পর তিনি শাহবাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। এ সময় দিল্লির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘােলাটে হয়ে ওঠে। শের শাহের বংশধরদের দুর্বলতার সুযােগে মুঘল বাদশাহ হুয়ায়ুন স্বীয় রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু দিল্লিতে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তার করার সুযােগ পেলেন না । হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরােহণ করে শূর বংশীয় আফগান নেতৃবৃন্দকে একে একে দমন করার জন্য অগ্রসর হলেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) আদিল শাহের সেনাপতি হিমু মুঘল সৈন্যদের নিকট পরাজিত ও নিহত হন।
এতে আদিল শাহ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি বাংলার দিকে পলায়ন করেন। পথিমধ্যে সুরজগড়ের নিকটবর্তী ফতেহপুরে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ কর্তৃক এক যুদ্ধে ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আদিল শাহ পরাজিত ও নিহত হন। বাংলা বিজয়ী আফগান সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হলে মুঘল সেনাপতি খান -ই-জামান তার গতিরােধ করেন। কূটকুশলী বাহাদুর শাহ খান-ই-জামানের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন।
এরপর তিনি বাংলার বাইরে আর কোনাে অভিযান চালাননি। ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা জালালউদ্দিন শূর দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন’ উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে আরােহণ করেন । তিনিও তাঁর ভ্রাতার ন্যায় মুঘলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতেন। ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তার একমাত্র পুত্র বাংলার সিংহাসনে আরােহণ করেন। কিন্তু তার নাম জানা যায়নি। মাত্র সাত মাস রাজত্ব করার পর তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নামে জনৈক আফগান দলনেতা তাঁকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু তিনিও বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। কররানি বংশের রাজা তাজ খান কররানি গিয়াসউদ্দিনকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তাজ খান কররানি ও সুলায়মান খান কররানি শের শাহের সেনাপতি ছিলেন। কনৌজের যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শের শাহ তাদের দক্ষিণ বিহারে জায়গির প্রদান করেন। ইসলাম শাহের রাজত্বকালে তাজ খান কররানি সেনাপতি ও কূটনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ইসলাম শাহের বালকপুত্র ও উত্তরাধিকারী ফিরােজের সময় তাজ খান উজির নিযুক্ত হন। ফিরােজকে হত্যা করে তাঁর মামা মুহম্মদ আদিল শূর সিংহাসনে বসেন।
এ সময় তাজ খান কররানি পালিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের সহায়তায় দক্ষিণ বিহারে প্রাধান্য স্থাপন করেন। ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তাজ খান কররানি নামমাত্র বাংলার সুলতান বাহাদুর শাহ নূরের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে পড়েন। বাংলার সিংহাসনের প্রতিও তাঁর দৃষ্টি ছিল। তিনি সুযােগের অন্বেষণে ছিলেন। অজ্ঞাতনামা গিয়াসউদ্দিন যখন শূর বংশের সিংহাসন দখল করেন, তখন সুযােগ বুঝে তাজ খান ও তাঁর ভ্রাতারাগিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করে গৌড় দখল করেন। এভাবে তাজ খান কররানি বাংলায় কররানি বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাজ খান কররানির মৃত্যুর পর ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ভাই সুলায়মান খান কররানি বাংলার সুলতান হন। এ দক্ষ শাসক আফগান নেতাদের তাঁর দলভুক্ত করেন।
এভাবে বাংলা ও বিহারের অধিকাংশ এলাকা তার অধিভুক্ত হয় । উড়িষ্যাতেও তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় । সােলায়মান কররানির বিজ্ঞ উজির ললাদি খানের পরামর্শে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম গৌড় থেকে মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তাণ্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে সােলায়মান কররানির মৃত্যু হলে পুত্র বায়জিদ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই এ অত্যাচারী সুলতানকে হত্যা করেন আফগান সর্দাররা। এবার সিংহাসনে বসেন সােলায়মান কররানির দ্বিতীয় পুত্র দাউদ কররানি। তিনিই ছিলেন বাংলায় শেষ আফগান শাসক। দাউদ কররানি খুব অদূরদর্শী শাসক ছিলেন। বিশাল রাজ্য ও ধন ঐশ্বর্য দেখে তিনি নিজেকে সম্রাট আকবরের সমকক্ষ ভাবতে থাকেন।
এতদিন বাংলা ও বিহারের আফগান শাসকগণ প্রকাশ্যে মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন। কিন্তু দাউদ স্বাধীন সম্রাটের মতাে বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজ নামে খুতবা পাঠ করেন ও মুদ্রা প্রচলন করেন। আফগানরা এমনিতেই মুঘলদের শত্রু ছিল । তার ওপর বাংলা-বিহার মুঘলদের অধিকারে না থাকায় সম্রাট আকবরের স্বস্তি ছিল না । দাউদ কররানির স্বাধীনচেতা মনােভাবের কারণে আকবর ক্ষুব্ধ হন। প্রথমে আকবর জৌনপুরের শাসনকর্তা মুনিম খানকে নির্দেশ দেন কররানি রাজ্য আক্রমণ করতে। প্রথম দিকে সরাসরি আক্রমণ করেননি মুনিম খান। উজির ললাদি খানের সাথে মুনিম খানের বন্ধুত্ব ছিল । দাউদ খান কররানি তার উজির লােদির পরামর্শে মুনিম খানের সাথে ধনরত্ন দিয়ে আপােস করেন। কিন্তু অচিরেই এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। দাউদ খান কিছু ষড়যন্ত্রকারীর পরামর্শে ভুল বােঝেন উজির লােদিকে। দাউদ খানের নির্দেশে হত্যা করা হয় তাঁকে।
লােদির বুদ্ধি আর বন্ধুত্বের গুণেই এতদিন মুঘল আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল বাংলা ও বিহার । তার অনুপস্থিতিতে মুনিম খানের বাংলা ও বিহার আক্রমণে আর বাধা রইল না । মুনিম খান তার বন্ধু লােদির মৃত্যুর পর ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিহার থেকে আফগানদের হটিয়ে দেন। আফগানরা ইতােমধ্যে নিজেদের ভেতর বিবাদ করে দুর্বল হয়ে পড়েছিল । এ সুযােগে মুনিম খান বাংলার দিকে অগ্রসর হন। কররানিদের বাংলার রাজধানী ছিল তাণ্ডায়। আফগানরা বাংলার রাজধানী তাণ্ডা ছেড়ে পিছু হটে। আশ্রয় নেয় হুগলি জেলার সপ্তগ্রামে। মুনিম খানের নেতৃত্বে রাজধানী অধিকার করে মুঘল সৈন্যরা ও অগ্রসর হয় সপ্তগ্রামে। দাউদ খান পালিয়ে যান উড়িষ্যায় । মুনিম খান তাণ্ডায় বাংলার মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তাণ্ডায় প্লেগ রােগ দেখা দিলে মুনিম খানসহ অনেক মুঘল সৈন্য এ রােগে মারা যান। ফলে বাংলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ অবস্থার সুযােগে দাউদ কররানি পশ্চিম ও উত্তর বাংলা পুনরায় অধিকার করে নেন। অন্যদিকে ভাটি অঞ্চলের জমিদার ঈসা খান পূর্ব বাংলা থেকে মুঘল সৈন্যদের হটিয়ে দেন।
মুঘল সৈন্যরা এবার বাংলা ছেড়ে বিহারে আশ্রয় নেয়। মুনিম খানের মৃত্যুসংবাদ আগ্রায় পৌছালে সম্রাট আকবর বাংলার শাসনকর্তা করে পাঠান খানজাহান হুসেন কুলি খানকে। তার সহকারী নিযুক্ত হন রাজা টোডরমল। বাংলায় প্রবেশপথে রাজমহলে মুঘল সৈন্যদের বাধা দেন দাউদ কররানি। মুঘলদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান তুরবাতি। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের নিকট মুঘল ও আফগানদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ কররানির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। পরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এভাবে বাংলায় কররানি (আফগান) শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়। অবশ্য বারােভূঁইয়াদের বাধার মুখে মুঘল শাসন বেশি দূর বিস্তৃত হতে পারেনি।
বারােভূঁইয়াদের ইতিহাস
সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদার মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি। জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন। তাদের শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী ও নৌবহর ছিল। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ বারােভূঁইয়া’ নামে পরিচিত। এ বারাে’ বলতে বারােজনের সংখ্যা বুঝায় না। ধারণা করা হয় অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারদের বােঝাতেই বারাে’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলার ইতিহাসে বারােভূঁইয়াদের আবির্ভাব যােলাে শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরাে শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। আলােচ্য সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ঐতিহাসিক দষ্টিতে তাঁরাই বারােভূঁইয়া। এছাড়াও, বঙ্গদেশে আরও অনেক ছােটখাটো জমিদার ছিলেন। তারাও মুঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ান । কিন্তু পরে তাঁরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। বারােভূঁইয়াদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন :
বারােভূঁইয়াদের নাম | এলাকার নাম |
ঈসা খান, মুসা খান | ঢাকা জেলার অর্ধাংশ, প্রায় সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা এবং পাবনা, বগুড়া ও রংপুর জেলার কিছু অংশ |
চাঁদ রায় ও কেদার রায় | শ্রীপুর (বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ) |
বাহাদুর গাজি | ভাওয়াল |
সােনা গাজি | সরাইল (ত্রিপুরার উত্তর সীমায়) |
ওসমান খান | বােকাইনগর (সিলেট) |
বীর হামির | বিষ্ণুপুর (বাকুড়া) |
লক্ষণ মাণিক্য | ভুলুয়া (নােয়াখালী) |
পরমানন্দ রায় | চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল) |
বিনােদ রায়, মধু রায় | চান্দপ্রতাপ (মানিকগঞ্জ) |
মুকুন্দরাম, সত্রজিৎ | ভূষণা (ফরিদপুর) |
রাজা কন্দর্পনারায়ণ, রামচন্দ্র | বরিশাল জেলার অংশবিশেষ |
প্রথম দিকে বারােভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান। হুসেন শাহি বংশের অবসান হলে ঈসা খানের পিতা সােলায়মান খান সােনারগাঁ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। খিজিরপুর দুর্গ ছিল তাঁর শক্তির প্রধান কেন্দ্র। সােনারগাঁ ও খিজিরপুরের নিকটবর্তী কাত্রাবু তাঁর রাজধানী ছিল। দাউদ কররানির পতনের পর তিনি সােনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করেন। বারােভূঁইয়াদের দমন করার জন্য সম্রাট আকবর বিশেষ মনােযােগ দেন।
এজন্য তিনি ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে শাহবাজ খান, ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সাদিক খান, ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে উজির খান ও ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। তাঁরা ঈসা খান ও অন্যান্য জমিদারের সাথে বহুবার যুদ্ধ করেন। কিন্তু বারােভূইয়াদের নেতা ঈসা খানকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। তিনি সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘােষণা করে মসনদ-ই-আলা’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা খানের মৃত্যু হলে বারােভূঁইয়াদের নেতা হন তাঁর পুত্র মুসা খান । এদিকে ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মানসিংহকে দ্বিতীয়বারের মতাে বাংলায় পাঠানাে হয়। এবার মানসিংহ কিছুটা সফল হন। ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে মুসা খান এক নৌযুদ্ধে মানসিংহের হাতে পরাজিত হন।
কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার আগে সম্রাট আকবরের অসুস্থতার খবর আসে। সম্রাটের ডাকে মানসিংহ আগ্রায় ফিরে যান। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীর’ নাম ধারণ করে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি মানসিংহকে আবার বাংলায় প্রেরণ করেন। এক বছর পর ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে কুতুব উদ্দিন কোকাকে বাংলার সুবাদার নিয়ােগ করা হয় । কুতুব উদ্দিন শের আফকুনের হাতে প্রাণ হারান। তার পরবর্তী সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি খান এক বছর পর মারা যান।
এর পর ইসলাম খান ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গের সুবাদার নিযুক্ত হন। বাংলার বারােভূঁইয়াদের দমন করে এদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের কৃতিত্বপূর্ণ কাজ। আর এ কৃতিত্বের দাবিদার সুবাদার ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে)। শাসনভার গ্রহণ করেই তিনি বুঝতে পারেন যে, বারােভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানকে দমন করতে পারলেই তাঁর পক্ষে অন্যান্য জমিদারকে বশীভূত করা সহজ হবে। সেজন্য তিনি রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
কারণ মুসা খানের ঘাঁটি সােনারগাঁ ঢাকার অদূরে ছিল। বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় আসার পথে ইসলাম খান কয়েকজন জমিদারের আনুগত্য লাভ করেছিলেন। বারােভূঁইয়াদের মােকাবেলা করার জন্য ইসলাম খান শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তােলেন। মুসা খানের সাথে প্রথম সংঘর্ষ বাধে ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে করতােয়া নদীর পূর্বতীরে যাত্রাপুরে। সেখানে মুসা খানের দুর্গ ছিল। যুদ্ধে মুসা খান ও অন্যান্য জমিদার শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন। ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রবেশ করেন।
এ সময় থেকে ঢাকা হয় বাংলার রাজধানী। সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর। এরপর পুনরায় মুসা খানের নেতৃত্বে মুঘলদের বাধা দেওয়ার জন্য জমিদারদের নৌবহর একত্রিত হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে । ইসলাম খান এর পশ্চিম তীরের বিভিন্ন স্থানে সৈন্য ও নৌবহর প্রেরণ করেন । ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খানের সঙ্গে জমিদারদের যুদ্ধ শুরু হয়। নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত মুসা খানের কদম * রসুল দুর্গসহ অন্যান্য দুর্গ মুঘলদের অধিকারে আসে। অবস্থার বিপর্যয়ে মুসা খান সােনারগাঁ চলে আসেন। ও রাজধানী নিরাপদ নয় মনে করে তিনি মেঘনা নদীতে অবস্থিত ইব্রাহিমপুর দ্বীপে আশ্রয় নেন।
মুঘল সৈন্যরা সােনারগাঁ অধিকার করে নেন। এর ফলে জমিদারগণ বাধ্য হন আত্মসমর্পণ করতে । কোনাে উপায় না দেখে মুসা খানও শেষ পর্যন্ত মুঘলদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। ইসলাম খান মুসা খানকে অন্যান্য জমিদারদের মতাে মুঘলদের অধীনস্থ জায়গিরের দায়িত্ব দিলেন। এরপর মুসা খান সম্রাটের অনুগত জায়গিরদার হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। মুসা খানের আত্মসমর্পণে অন্যান্য জামিদার নিরাশ হয়ে মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন। এভাবে বাংলায় বারােভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে।