রাজা গণেশ ও হাবসি শাসন এবং পরবর্তী ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন

Preparation BD
By -
0

রাজা গণেশ ও হাবসি শাসন

সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, বাংলার ইতিহাসের দুইশ’ বছর (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলমান সুলতানদের স্বাধীন রাজত্বের যুগ। তথাপি এই দুইশ’ বছরের মাঝামাঝি অল্প সময়ের জন্য কিছুটা বিরতি ছিল। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফুদ্দিন হামজা শাহ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু এ সময় অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতা দখল নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। তিনি এক বছর শাসন করার পর ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ক্রীতদাস শিহাব উদ্দিনের হাতে নিহত হন। শিহাব উদ্দিন সুলতান হয়ে নিজের নাম নেন শিহাব উদ্দিন বায়াজিদ শাহ’। কিন্তু দুই বছরের মাথায় ১৪১৪-১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনিও ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন। এ সুযােগে হিন্দু অভিজাত রাজা গণেশ বাংলার ক্ষমতা দখল করেন।

বাংলার সুলতানরা অনেক উচ্চপদেই হিন্দুদের নিয়ােগ করতেন। আজম শাহের একজন উচ্চপদস্থ অমাত্য ছিলেন রাজা গণেশ। জানা যায় গণেশ প্রথমে দিনাজপুরের ভাতুলিয়া অঞ্চলের একজন রাজা ছিলেন। তিনি সুলতানের দরবারে চাকরি নেন। চাকরি নিয়েই তিনি গােপনে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। তার ইচ্ছে ছিল মুসলমানদের হটিয়ে পুনরায় হিন্দুশক্তির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যেই তিনি ইলিয়াস শাহি বংশ উচ্ছেদ করে নিজে ক্ষমতায় বসেন। গণেশ অনেক সুফি সাধককে হত্যা করেন। মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য দরবেশদের নেতা নূর কুতুব-উল-আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কির নিকট আবেদন জানান ।

ইব্রাহিম শর্কি সসৈন্যে বাংলায় উপস্থিত হলে গণেশ ভয় পেয়ে যান। অবশেষে, তিনি আপােস করেন দরবেশ নূর কুতুব-উল-আলমের সাথে। শর্ত অনুযায়ী গণেশ তাঁর ছেলে যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং ছেলের হাতে বাংলার সিংহাসন ছেড়ে দেন। মুসলমান হওয়ার পর যদুর নাম হয় জালালউদ্দিন মাহমুদ। সুলতান ইব্রাহিম শর্কি জালালউদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে ফিরে যান নিজ দেশ জৌনপুরে।

গণেশ দুইবার সিংহাসনে বসেছিলেন। প্রথমবার কয়েক মাস মাত্র ক্ষমতায় ছিলেন। ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি ইব্রাহিম শর্কি জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহকে সিংহাসনে বসান। ইব্রাহিম শর্কি ফিরে গেলে নিজেকে নিরাপদ মনে করেন গণেশ । তখন জালালউদ্দিনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। অনেক আচার-অনুষ্ঠান করিয়ে ছেলেকে আবার হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন। গণেশ ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

রাজা গণেশের মৃত্যুর পর হিন্দু আমাত্যগণ গণেশের পুত্র মহেন্দ্রদেবকে বঙ্গে সিংহাসনে বসান। কিন্তু অতি অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করে জালালউদ্দিন দ্বিতীয়বার বঙ্গের সিংহাসনে আরােহণ করেন। এ পর্যায়ে তিনি একটানা ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এ সুযােগ্য শাসকের সময় বাংলার রাজ্যসীমা অনেক বৃদ্ধি পায়। প্রায় সমগ্র বাংলা এবং আরাকান ব্যতীত ত্রিপুরা ও দক্ষিণ বিহারেরও কিছু অংশ সাময়িকভাবে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

রাজ্যের বিভিন্ন টাকশাল থেকে তাঁর নামে মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। পাণ্ডুয়া থেকে তিনি গৌড়ে তার রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আহমদ শাহ অমাত্যবর্গের ষড়যন্ত্রে সাদি খান ও নাসির খান নামক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন। এভাবে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের প্রায় ত্রিশ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটে।

পরবর্তী ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন

শামসুদ্দিন আহমদ শাহের মৃত্যুর পর তার হত্যাকারী ক্রীতদাস নাসির খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু আহমদ শাহকে হত্যা করার ব্যাপারে যে অভিজাতবর্গ ইন্ধন দেয়, তারা নাসির খানের সিংহাসনে আরােহণকে খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেনি। সম্ভবত ক্রীতদাসের আধিপত্যকে তারা অপমানজনক মনে করেছিল। তাই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাসির খানকে হত্যা করে। নাসির খান নিহত হওয়ার পর গৌড়ের সিংহাসন কিছু সময়ের জন্য শূন্য অবস্থায় পড়ে রইল । আহমদ শাহের কোনাে পুত্রসন্তান ছিল না । অতঃপর অভিজাতবর্গ মাহমুদ নামে ইলিয়াস শাহের এক বংশধরকে ১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সিংহাসনে বসায়।

ইতিহাসে তিনি নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ নামে পরিচিত। ইলিয়াস শাহের বংশধরগণ এভাবে পুনরায় স্বাধীন রাজত্ব শুরু করেন। তাই এ যুগকে বলা হয় পরবর্তী ইলিয়াস শাহি যুগ। নাসিরউদ্দিন একজন দক্ষ সেনাপতি ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। যশাের ও খুলনা অঞ্চল নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে মুসলমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গ, পূর্ব বঙ্গ, উত্তর বঙ্গ ও বিহারের কতকাংশ তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তিনি নিজ নামে মুদ্রাও প্রচলন করেছিলেন।

১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। পিতার রাজত্বকাল থেকেই বরবক শাহ শাসক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা । তাঁর রাজত্বকালে বাংলার রাজ্যসীমা অনেক বৃদ্ধি পায় । গঙ্গা নদীর উত্তরাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ভাগলপুর তাঁর শাসনকালে মুসলমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব নিয়ে গােলযােগ ছিল। বরবক শাহের রাজত্বকালের প্রথম দিকে এটি আরাকান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। কিন্তু শেষ দিকে বরবক শাহ তা পুনরুদ্ধার করেন। যশাের ও খুলনা তার অধিকারে ছিল। তিনি দক্ষিণ দিকেও তাঁর রাজ্য বিস্তৃত করেছিলেন। বরবক শাহই প্রথম অসংখ্য আবিসিনীয় ক্রীতদাস (হাবসি ক্রীতদাস) সংগ্রহ করে সেনাবাহিনী ও রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করেন। নিয়ােগকৃত এ হাবসি ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল আট হাজার।

তিনি সম্ভবত রাজ্যে একটি নিজস্ব দল গঠনের উদ্দেশ্যে এই হাবসিদের নিয়ে বাহিনী গঠন করেছিলেন। কিন্তু তার এ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনে। সুলতান রুকনউদ্দিন বরবক শাহ একজন মহাপণ্ডিত ছিলেন। বিভিন্ন শিলালিপিতে তাঁর নামের পাশে নিজ নামে এবং বিভিন্ন রাজকীয় আল-ফাজিল’ ও ‘আল-কামিল’ এ দুইটি উপাধির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। ৯ এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বরবক শাহ শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি শুধু পণ্ডিতই ও ছিলেন না, সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকও ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মেরই বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তি তার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন।

তিনি যে একজন উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনের নরপতি ছিলেন তা হিন্দু কবি-পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপােষকতা ও বহু হিন্দুকে উচ্চ রাজপদে নিয়ােগ করা থেকে বুঝা যায়। এদিক দিয়ে বরবক শাহের মতাে উদার মনােভাবাপন্ন শাসক শুধু বাংলার ইতিহাসে নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসেও দুর্লভ। বরবক শাহ একজন প্রকৃত সৌন্দর্যরসিক ছিলেন। গৌড়ের দাখিল দরওয়াজা’ নামে পরিচিত বিরাট ও সুন্দর তােরণটি বরবক শাহই নির্মাণ করিয়েছিলেন। এ আমলে চট্টগ্রাম এবং পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জে দুইটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এ সমস্ত কার্যক্রম বিবেচনা করলে বঙ্গের সুলতানদের মধ্যে বরবক শাহকে অন্যতম বলা যায়।

১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বরবক শাহ পরলােকগমন করেন। পরে তাঁর পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সুলতান হন । পিতা ও পিতামহের গড়া বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর সময় অক্ষুন্ন ছিল। তাঁর রাজ্য পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং পূর্বে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে বসেন । কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে অপসারণ করা হয়। বরবক শাহের ছােট ভাই হুসাইন ‘জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন (১৪৮১-১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি নিজ নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। কিন্তু এ সময় রাজদরবারে দুর্যোগ দেখা দেয় ।

হাবসি ক্রীতদাসরা এ সময় খুব ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। তাদের প্র প কমানাের জন্য জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ চেষ্টা করেন। এতে সমস্ত হাবসি ক্রীতদাস একজোট হয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সুলতান শাহজাদা ছিলেন প্রাসাদরক্ষী দলের প্রধান। ক্রীতদাসরা প্রলােভন দ্বারা সুলতান শাহজাদা ও তার অধীনস্থ পাইকদের নিজ দলভুক্ত করে। শাহজাদা রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে ফতেহ শাহূকে হত্যা করেন। ফতেহ শাহ নিহত হলে বাংলার সিংহাসনে ইলিয়াস শাহি বংশের শাসনকালের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলায় হাবসিদের রাজত্বের সূচনা হয়।

হাবসি শাসন

বাংলায় হাবসি শাসন মাত্র ছয় বছর(১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) স্থায়ী ছিল। এ সময় এদেশের ইতিহাস ছিল অন্যায়, অবিচার, বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র আর হতাশায় পরিপূর্ণ। এ সময়ে চারজন হাবসি সুলতানের মধ্যে তিনজনকেই হত্যা করা হয়।

হাবসি নেতা সুলতান শাহজাদা বরবক শাহ’ উপাধি নিয়ে প্রথম বাংলার ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হাবসি সেনাপতি মালিক আন্দিলের হাতে নিহত হন। মালিক আন্দিল ‘সাইফুদ্দিন ফিরুজ শাহ’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। একমাত্র তার তিন বছরের রাজত্বকালের (১৪৮৭-১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দ) ইতিহাসই কিছুটা গৌরবময় ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন দ্বিতীয় নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ । কিন্তু কিছুকাল (১৪৯০-১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব করার পরই তিনি নিহত হন।

এক হাবসি সর্দার তাঁকে হত্যা করে ‘শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ’ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন (১৪৯১-১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ)। অত্যাচারী ও হত্যাকারী হিসেবে তার কুখ্যাতি ছিল। ফলে গৌড়ের সম্রান্ত লােকেরা মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীদের সাথে যােগ দেন মুজাফফর শাহের উজির সৈয়দ হােসেন। অবশেষে মুজাফফর শাহ নিহত হন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় হাবসি শাসনের অবসান ঘটে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !