নাগরিক ও নাগরিকতা : আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে আমরা প্রত্যেকে কতিপয় অধিকার ভােগ এবং কর্তব্য পালন করি। আবার কতগুলাে গুণের অধিকারী হয়ে আমরা সুনাগরিকে পরিণত হতে পারি। সুনাগরিক রাষ্ট্রের সম্পদ। আমাদের প্রত্যেকের সুনাগরিকতার শিক্ষা লাভ করা অত্যাবশ্যক। এ অধ্যায়ে নাগরিক ও নাগরিকতার ধারণা, নাগরিকতা অর্জনের উপায়, দ্বৈত নাগরিকতা, সুনাগরিকের ধারণা ও বৈশিষ্ট্য, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে।
এ অধ্যায় পড়া শেষে আমরা
- নাগরিক ও নাগরিকতার ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
- নাগরিকতা অর্জনের উপায় বর্ণনা করতে পারব।
- দ্বৈত নাগরিকতা ব্যাখ্যা করতে পারব।
- সুনাগরিকতার ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
- নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা বর্ণনা করতে পারব।
- নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারব।
- নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আগ্রহী হব ।
নাগরিক ও নাগরিকতা
আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসে নাগরিক ও নাগরিকতার ধারণার উদ্ভব হয়। প্রাচীন গ্রিসে তখন নগরকেন্দ্রিক ছােট ছােট রাষ্ট্র ছিল, সেগুলােকে নগর-রাষ্ট্র বলা হতাে। এসব নগর-রাষ্ট্রে যারা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করত তারা নাগরিক হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের ভােটাধিকার ছিল। তবে নগর-রাষ্ট্রে নারী, বিদেশি ও গৃহভৃত্য-এরা নাগরিক ছিল না।
সময়ের পরিক্রমায় নাগরিকত্বের ধারণায় অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে নাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোনাে পার্থক্য করা হয় না। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। কারণ, আমরা এদেশে জন্মগ্রহণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি, রাষ্ট্রপ্রদত্ত সকল প্রকার অধিকার (সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ) ভােগ করছি এবং রাষ্ট্রের প্রতি বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছি।
আরো পড়ুন :
- বাংলাদেশ সরকারের স্বরূপ ও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
- বাংলাদেশের সংবিধানের সংশােধনীসমূহ
- বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- লিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ
- সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি
- সংবিধানের ধারণা ও গুরুত্ব
- আইন ও শাসন বিভাগের সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণিবিভাগ
- পৌরনীতি ও নাগরিকতা | পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ের পরিসর বা বিষয়বস্তু
- পরিবার কি | পরিবারের শ্রেণিবিভাগ | পরিবারের কার্যাবলি
- রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি ও কি কি ?
সুতরাং আমরা বলতে পারি, যে ব্যক্তি কোনাে রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে, রাষ্ট্রপ্রদত্ত অধিকার ভােগ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করে, তাকে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক বলে। নাগরিক ও নাগরিকতাকে কেউ কেউ একই অর্থে ব্যবহার করেন। আসলে এদের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ রয়েছে। নাগরিক হলাে ব্যক্তির পরিচয়। যেমন- আমাদের পরিচয় আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আর রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি যে মর্যাদা ও সম্মান পেয়ে থাকে তাকে নাগরিকতা বলে ।
নাগরিকতা অর্জনের পদ্ধতি
নাগরিকতা অর্জনের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। যেমন- ক) জন্মসূত্র ও খ) অনুমােদন সূত্র।
ক. জন্মসূত্রে নাগরিকতা অর্জনের পদ্ধতি : জন্মসূত্রে নাগরিকতা অর্জনের ক্ষেত্রে দুটি নীতি অনুসরণ করা যথা- ১। জন্মনীতি ও ২। জন্মস্থান নীতি।
১. জন্মনীতি : এ নীতি অনুযায়ী পিতা-মাতার নাগরিকতা দ্বারা সন্তানের নাগরিকতা নির্ধারিত হয়। এ ক্ষেত্রে শিশু যে দেশে বা যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, পিতা-মাতার নাগরিকতা দ্বারা সন্তানের নাগরিকতা নির্ধারিত হয়। যেমন- বাংলাদেশের এক দম্পতি যুক্তরাজ্যে গিয়ে একটি সন্তান জন্ম দিল। এ নীতি অনুসারে ঐ সন্তান বাংলাদেশের নাগরিকতা লাভ করবে। কারণ তার পিতা-মাতা বাংলাদেশের নাগরিক।
২. জন্মস্থান নীতি : এ নীতি অনুযায়ী পিতা-মাতা যে দেশেরই নাগরিক হােক না কেন, সন্তান যে রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করবে সে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করবে। যেমন- বাংলাদেশি পিতা-মাতার সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে, সেই সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিকতা নির্ধারণে রাষ্ট্রকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ নীতি অনুযায়ী কোনাে মা-বাবার সন্তান অন্য দেশের জাহাজ বা দূতাবাসে জন্মগ্রহণ করলেও জাহাজ বা দূতাবাস যে দেশের সে ঐ দেশের নাগরিক হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, জন্মসূত্রে নাগরিকতা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ জন্মনীতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। অন্যদিকে, আমেরিকা, কানাডাসহ অল্প কয়েকটি দেশ জন্মস্থান নীতির মাধ্যমে নাগরিকতা নির্ধারণ করে।
খ. অনুমােদন সূত্রে নাগরিকতা অর্জনের পদ্ধতি : কতগুলাে শর্ত পালনের মাধ্যমে এক রাষ্ট্রের নাগরিক অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকতা অর্জন করলে তাকে অনুমােদন সূত্রে নাগরিক বলা হয়। সাধারণত অনুমােদন সূত্রে নাগরিকতা অর্জনের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত পালন করতে হয় সেগুলাে হলাে-
- সেই রাষ্ট্রের নাগরিককে বিয়ে করা
- সরকারি চাকরি করা
- সততার পরিচয় দেওয়া
- সে দেশের ভাষা জানা
- সম্পত্তি ক্রয় করা
- দীর্ঘদিন বসবাস করা
- সেনাবাহিনীতে যােগদান করা। রাষ্ট্রভেদে এসব শর্ত ভিন্ন হতে পারে।
কোনাে ব্যক্তি যদি এসব শর্তের এক বা একাধিক শর্ত পূরণ করে, তবে তাকে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হয়। আবেদন ঐ রাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক গৃহীত হলে সে অনুমােদন সূত্রে নাগরিকে পরিণত হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে অনুমােদন সূত্রে নাগরিকত্ব লাভের মাধ্যমে বসবাস করছে। তাছাড়া মানবিক কারণেও নাগরিকতা দেওয়া ৯ হয়। যেমন- কোনাে ব্যক্তি যদি কোনাে রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়, তবে সেই রাষ্ট্র তার আবেদনের ভিত্তিতে তাকে নাগরিকত্ব দিতে পারে।
দ্বৈত নাগরিকতা
একজন ব্যক্তির একই সঙ্গে দুটি রাষ্ট্রের নাগরিকতা অর্জনকে দ্বৈত নাগরিকতা বলে। সাধারণত একজন ব্যক্তি একটিমাত্র রাষ্ট্রের নাগরিকতা অর্জনের সুযােগ পায়। তবে জন্মসূত্রে নাগরিকতা অর্জনের দুটি নীতি থাকায় কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- বাংলাদেশ নাগরিকতা নির্ধারণে জন্মনীতি অনুসরণ করে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জন্মনীতি ও জন্মস্থান উভয় নীতি অনুসরণ করে।
কাজেই বাংলাদেশের পিতা-মাতার সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে সেই সন্তান জন্মস্থান নীতি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকতা লাভ করবে । আবার জন্মনীতি অনুযায়ী সে বাংলাদেশের নাগরিকতা অর্জন করবে। এক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকতার সৃষ্টি হবে। তবে পূর্ণবয়স্ক হলে তাকে যেকোনাে একটি রাষ্ট্রের অর্থাৎ বাংলাদেশ কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে ।