সমাস দিয়ে শব্দ গঠন
সমাসের মাধ্যমে নতুন শব্দ গঠিত হয়। বাক্যের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কিত একাধিক পদের এক শব্দে পরিণত হওয়ার নাম সমাস। নিচের বাক্য দুটির দিকে তাকানাে যাক:
১ম বাক্য: পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার সময় সংক্রান্ত সূচি স্কুল ও কলেজে পাঠানাের নির্দেশ দিয়েছেন।
২য় বাক্য: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার সময়সূচি স্কুল-কলেজে পাঠানাের নির্দেশ দিয়েছেন ।
১ম বাক্যের পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক’, সময় সংক্রান্ত সূচি এবং স্কুল ও কলেজ পদগুলাে ২য় বাক্যে যথাক্রমে ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, সময়সূচি এবং স্কুল-কলেজ হিসেবে সংক্ষিপ্ত হয়েছে। এই সংক্ষেপ প্রক্রিয়ার নাম সমাস।
সমাসবদ্ধ শব্দকে বলে সমস্তপদ, যেমন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’, সময়সূচি এবং স্কুল-কলেজ। সমস্যমান পদের প্রথম অংশের নাম পূর্বপদ এবং শেষ অংশের নাম পরপদ। এখানে পরীক্ষা, সময় ও স্কুল হলাে পূর্বপদ এবং ‘নিয়ন্ত্রক’, ‘সূচি ও কলেজ হলাে পরপদ।
যেসব শব্দ দিয়ে সমস্তপদকে ব্যাখ্যা করা হয়, তাকে ব্যাসবাক্য বলে। এখানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদের ব্যাসবাক্য হলাে ‘পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক, সময়সূচি পদের ব্যাসবাক্য হলাে সময় সংক্রান্ত সূচি এবং স্কুলকলেজ পদের ব্যাসবাক্য হলাে স্কুল ও কলেজ। এছাড়া যেসব পদ নিয়ে সমাস হয়, সেগুলােকে সমস্যমান পদ বলে। ১ম বাক্যের পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক পদগুলাের পরীক্ষাসমূহের’ এবং নিয়ন্ত্রক হলাে সমস্যমান পদ।
এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন
- ক্রিয়াবিশেষণ
- ক্রিয়া
- বিশেষণ
- সর্বনাম
- বিশেষ্য
- শব্দের শ্রেণিবিভাগ
- সংখ্যাবাচক শব্দ
- অর্থের দিকে দিয়ে বাক্যকে কয় ভাগে ভাগ করা যায়? প্রত্যেকটির সংজ্ঞা ও উদাহরণ দাও।
- নরবাচক ও নারীবাচক শব্দ
- শব্দদ্বিত্ব : অনুকার দ্বিত্ব, ধ্বন্যাত্মক দ্বিত্ব, পুনরাবৃত্ত দ্বিত্ব
সমস্তপদ সাধারণত এক শব্দ হিসেবে লেখা হয়, যেমন সময়সূচি। উচ্চারণ বা অর্থের বিভ্রান্তি ঘটার আশঙ্কায় কিছু ক্ষেত্রে পূর্বপদ ও পরপদের মাঝখানে হাইফেন (-) বসে, যেমন স্কুল-কলেজ। কিছু ক্ষেত্রে পূর্বপদ ও পরপদকে আলাদা লেখা হয়, যেমন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। সমাস মূলত চার প্রকার। যথা: দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ ও বহুব্রীহি।
১. দ্বন্দ্ব সমাস
দ্বন্দ্ব সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ উভয় পদের অর্থের সমান প্রাধান্য থাকে। যেমন – ‘সােনা-রুপা সমস্তপদের ব্যাসবাক্য ‘সােনা ও রুপা। নিচের বাক্যে সমস্তপদটির প্রয়োেগ থেকে এর পূর্বপদ ও পরপদের অর্থের প্রাধান্য বােঝা যাবে:
সােনা-রুপার দাম বেড়ে গেছে।
অর্থাৎ সােনার দামও বেড়ে গেছে, রুপার দামও বেড়ে গেছে।
দ্বন্দ্ব সমাসের ক্ষেত্রে সমজাতীয়, বিপরীত ও অনুরূপ শব্দের সংযােগ ঘটে। যেমন – মা ও বাবা = মা-বাবা, স্বর্গ ও নরক = স্বর্গ-নরক, জমা ও খরচ = জমাখরচ, হাত ও পা = হাত-পা, উনিশ ও বিশ = উনিশ-বিশ, ঝড় ও বৃষ্টি = ঝড়বৃষ্টি, পােটলা ও পুটলি = পােটলা-পুটলি, তুমি ও আমি = তুমি-আমি, আসা ও যাওয়া = আসা-যাওয়া, ধীরে ও সুস্থে = ধীরেসুস্থে, ভালাে ও মন্দ = ভালােমন্দ।
কিছু দ্বন্দ্ব সমাসে পূর্বপদ ও পরপদের বিভক্তি সমাসবদ্ধ হলেও বিদ্যমান থাকে। এই ধরনের দ্বন্দ্ব সমাসের নাম অলুক দ্বন্দ্ব সমাস। যেমন – হাতে ও কলমে = হাতে-কলমে, চোখে ও মুখে = চোখেমুখে, চলনে ও বলনে = চলনে-বলনে ইত্যাদি।
সমস্যমান পদ কখনাে কখনাে দুইয়ের বেশি হতে পারে। যেমন – সাহেব, বিবি ও গােলাম = সাহেব-বিবি-গােলাম; হাত, পা, চোখ ও কান = হাত-পা-চোখ-কান ইত্যাদি।
২. কর্মধারয় সমাস
যে সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন – গােলাপ নামের ফুল = গােলাপফুল, যা কাঁচা তাই মিঠা = কাঁচা-মিঠা।
ক. কিছু কর্মধারয় সমাসের সমস্যমান পদে যে’ যােজক থাকে, যেমন –
- খাস যে জমি = খাসজমি
- চিত যে সঁতার = চিতসাঁতার
- ভাজা যে বেগুন = বেগুনভাজা
- সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ
- কনক যে চাঁপা = কনকচাপা
- টাক যে মাথা = টাকমাথা
- যে চালাক সে চতুর = চালাকচতুর
- যে শান্ত সে শিষ্ট = শান্তশিষ্ট
খ. কিছু কর্মধারয় সমাসের পূর্বপদ সংখ্যাবাচক শব্দ হয়, সেগুলােকে দ্বিগু কর্মধারয় বলে। যেমন –
- তিন ফলের সমাহার = ত্রিফলা
- চার রাস্তার মিলন = চৌরাস্তা।
গ. কিছু কর্মধারয় সমাসে সমস্যমান পদের মধ্যবর্তী এক বা একাধিক পদ লােপ পায়। এগুলাে মধ্যপদলােপী কর্মধারয় নামে পরিচিত। যেমন –
- ঘি মাখানাে ভাত = ঘিভাত
- হাতে পরা হয় যে ঘড়ি = হাতঘড়ি
- ঘরে আশ্রিত জামাই = ঘরজামাই
- বিজয় নির্দেশক পতাকা = বিজয়-পতাকা
ঘ. যার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা উপমান। কিছু কর্মধারয় সমাসে উপমানের সঙ্গে গুণবাচক শব্দের সমাস
হয়। এগুলােকে উপমান কর্মধারয় বলে। যেমন –
- কাজলের মতাে কালাে = কাজলকালাে
- শশের মতাে ব্যস্ত = শশব্যস্ত
এই সমাসে পরপদ সাধারণত বিশেষণ হয়।
ঙ. যাকে তুলনা করা হয়, তা উপমেয়। কিছু কর্মধারয় সমাসে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের সমাস হয়। এগুলােকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন –
- পুরুষ সিংহের ন্যায় = সিংহপুরুষ
- আঁখি পদ্মের ন্যায় = পদ্মআঁখি
- মুখ চন্দ্রের ন্যায় = চন্দ্রমুখ
এই সমাসে উভয় পদই বিশেষ্য হয়।
চ. কিছু কর্মধারয় সমাসে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের অভেদ কল্পনা করা হয়। এগুলােকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন –
- বিষাদ রূপ সিন্ধু = বিষাদসিন্ধু
- মন রূপ মাঝি = মনমাঝি।
৩. তৎপুরুষ সমাস
সমস্যমান পদের বিভক্তি ও সন্নিহিত অনুসর্গ লােপ পেয়ে যে সমাস হয়, তার নাম তৎপুরুষ সমাস। এই সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়।
ক. বিভক্তি লােপ পাওয়া তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ:
- দুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত
- ছেলেকে ভুলানাে = ছেলে-ভুলানাে
- মামার বাড়ি = মামাবাড়ি
- ধানের খেত = ধানখেত
- পথের রাজা = রাজপথ
- গােলায় ভরা = গােলাভরা
- গাছে পাকা = গাছপাকা
- অকালে মৃত্যু = অকালমৃত্যু।
খ. সন্নিহিত অনুসর্গ লােপ পাওয়া তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ:
- মধু দিয়ে মাখা = মধুমাখা
- চিনি দিয়ে পাতা = চিনিপাতা
- রান্নার জন্য ঘর = রান্নাঘর
- বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়েপাগলা
- গ্রাম থেকে ছাড়া = গ্রামছাড়া
- আগা থেকে গােড়া = আগাগােড়া।
গ. কিছু ক্ষেত্রে বিভক্তি লােপ পায় না, এসব তৎপুরুষ সমাসের নাম অলুক তৎপুরুষ, যেমন –
- গরুর গাড়ি = গরুরগাড়ি
- তেলে ভাজা = তেলেভাজা।
৪. বহুব্রীহি সমাস
যে সমাসে পূর্বপদ বা পরপদ কোনােটির অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কিছু বােঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন – বউ ভাত পরিবেশন করে যে অনুষ্ঠানে = বউভাত, লাঠিতে লাঠিতে যে যুদ্ধ = লাঠালাঠি ইত্যাদি।
ক. পূর্বপদ বিশেষণ এবং পরপদ বিশেষ্য হলে তাকে সমানাধিকার বহুব্রীহি বলে। যেমন –
- এক গো যার = একগুঁয়ে
- লাল পাড় যে শাড়ির = লালপেড়ে।
খ. পূর্বপদ ও পরপদ উভয়ই বিশেষ্য (কখনাে কখনাে ক্রিয়াবিশেষ্য) হলে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি হয়। যেমন –
- গোঁফে খেজুর যার = গোঁফখেজুরে।
গ. যে বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্য থেকে এক বা একাধিক পদ লােপ পায়, তাকে পদলােপী বহুব্রীহি বলে। যেমন –
- চিরুনির মতাে দাঁত যার = চিরুনতি
- হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি।
ঘ. পারস্পরিক ক্রিয়ায় কোনাে অবস্থা তৈরি হলে ব্যতিহার বহুব্রীহি হয়। যেমন –
- হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি
- কানে কানে যে কথা = কানাকানি।
ঙ. যে বহুব্রীহি সমাসে সমস্যমান পদের পূর্বপদের বিভক্তি অক্ষুন্ন থাকে, তাকে অলুক বহুব্রীহি বলে। যেমন –
- গায়ে এসে পড়ে যে = গায়েপড়া
- কানে খাটো যে = কানেখাটো।
চ. যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ সংখ্যাবাচক, তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন –
- চার ভুজ যে ক্ষেত্রের = চতুর্ভুজ
- সে (তিন) তার যে যন্ত্রের = সেতার।
অনুশীলনী
সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দাও।
১. সমাসের মাধ্যমে গঠিত হয় –
ক. নতুন শব্দ
খ. নতুন বাক্য
গ. নতুন বর্ণ
ঘ. নতুন ধ্বনি
২. সমাসবদ্ধ পদকে বলে –
ক. সমস্তপদ
খ. সমস্যমান পদ
গ.পূর্বপদ
ঘ.পরপদ
৩. ব্যাসবাক্য কাকে ব্যাখ্যা করে?
ক. পূর্বপদ
খ. পদ।
গ. সমস্তপদ
ঘ. সমস্যমান পদ
৪. পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার সময়সূচি স্কুল-কলেজে পাঠানাের নির্দেশ দিয়েছেন’ – এই বাক্যে সময়সূচি কোন পদ?
ক. সমস্তপদ
খ. সমস্যমান পদ
গ.পূর্বপদ।
ঘ, পরপদ
৫. অর্থের প্রাধান্যের ভিত্তিতে বাংলা সমাস কত প্রকার?
ক. দুই
খ. তিন
গ. চার
ঘ. পাঁচ
৬. নিচের কোনটি দ্বন্দ্ব সমাসের উদাহরণ?
ক. নয়-ছয়
খ. খাসজমি
গ. কনকচাপা
ঘ. ত্রিফলা
৭. নিচের কোনটি কর্মধারয় সমাসের উদাহরণ?
ক. হাতঘড়ি
খ. চোখে-মুখে
গ. সেতার
ঘ. তেলেভাজা
৮. নিচের কোনটির ব্যাসবাক্যে ‘যে’ যােজক রয়েছে?
ক. বেগুনভাজা
খ. ত্রিফলা
গ. ঘরজামাই
ঘ. হাতঘড়ি
৯. মধ্যপদলােপী কর্মধারয়ের উদাহরণ কোনটি?
ক. চৌরাস্তা
খ. ঘিভাত
গ. চালাকচতুর
ঘ. টাকমাথা
১০. উপমিত কর্মধারয় সমাসের উদাহরণ কোনটি?
ক. চাঁদমুখ
খ. শশব্যস্ত
গ. হাতঘড়ি
ঘ. বিষাদসিন্ধু
১১. নিচের কোনটিতে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের অভেদ কল্পনা করা হয়েছে?
ক. কাজলকালাে
খ. মনমাঝি
গ. তুষারশুভ্র
ঘ. চৌরাস্তা
১২. বিভক্তি লােপ পাওয়া তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ কোনটি?
ক. ছেলে-ভুলানাে
খ. তেলেভাজা
গ. গরুরগাড়ি
ঘ. হাতে কাটা
১৩. নিচের কোনটি অলুক তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ?
ক. গ্রামছাড়া
খ. গাছপাকা
গ. ধানক্ষেত
ঘ. গরুরগাড়ি
১৪. কোন সমাসে পূর্বপদ ও পরপদের কোনােটির অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কিছু বােঝায়?
ক. দ্বিগু সমাস
খ. তৎপুরুষ সমাস
গ. বহুব্রীহি সমাস
ঘ. কর্মধারয় সমাস
১৫. যে বহুব্রীহি সমাসে সমস্তপদে পূর্বপদের বিভক্তি অক্ষুন্ন থাকে তাকে কী বলে?
ক. সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি
খ. ব্যতিহার বহুব্রীহি
গ. পদলােপী বহুব্রীহি
ঘ. অলুক বহুব্রীহি