শতবর্ষে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Preparation BD
By -
0

বাঙালির সব অর্জনের সাথে জড়িয়ে আছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। বাঙালির ভাষার অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের পরতে পরতে নিরন্তর অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয় তথা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষককর্মচারী। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একই সাথে লড়তে হয়েছে একটি হচ্ছে জ্ঞানের চর্চা, অপরটি সামাজিকতার, সামাজিক দায়বদ্ধতা পূরণে। অবশ্য এ ধরনের দ্বিমুখী লড়াইটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই সত্য।

কিন্তু কম বিশ্ববিদ্যালয়কেই এই দ্বৈত কর্তব্য এমন উচ্চমাত্রায়, উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে পালন করতে হয়নি যতটা করতে হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। এটি সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই জ্ঞান বৃদ্ধি, জ্ঞানার্জনের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করা। এই জ্ঞান অর্জিত কিছুটা কিতাবি বাদবাকি বেশির ভাগই হয় জনমানুষের ভেতর থেকে, কিছুটা সামাজিকভাবে। পরে অর্জিত জ্ঞান চলে যায় সমাজে। মানুষের কাজে লাগে, উপকার হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে লড়াইটা ছিলাে তীব্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশেই ছিলাে পরিবেশের ও পরিস্থিতির বৈরিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চ্যান্সেলর, বাংলার এক ইংরেজ গভর্নর, সমাবর্তনের এক অনুষ্ঠানে কৌতুক করে মন্তব্য করেছিলেন ছাত্রদের যাকেই জিজ্ঞেস করেন লক্ষ্য কী, বলে সার্ভিস।

সার্ভিস অর্থ যদি সেবা হতাে, তাহলে তাে ভালােই ছিলাে, কিন্তু সার্ভিস বলতে সেবা নয়, ছেলে-মেয়েরা বােঝায় চাকরি । কথাটা নিতান্ত মিথ্যা নয়। বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে সর্বজনীন দাবির মুখে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১০০ বছরে বলতে গেলে বাঙালির সব অর্জনের সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে আছে সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অর্জনগুলাের পেছনে অনন্য ভূমিকা রাখা দেশের এই বিদ্যাপীঠ এক জীবন্ত কিংবদন্তি। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।

পৃথিবীর আর কোনাে বিশ্ববিদ্যালয়ের এত অর্জন নেই। বাঙালি জাতির আন্দোলনের বাতিঘর হিসেবে যুগ যুগ ধরে আলাে ছড়াচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই বাতিঘর জাতিকে আলাে দেখাতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল। গত ১ জুলাই শত বছরে পদার্পণ করলাে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছরে পদার্পণ উপলক্ষে এক বাণীতে উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে প্রিয় মাতৃভূমি ও গণমানুষের প্রতি আমাদের অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ গণমানুষের সব লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা নেতৃত্ব দিয়েছে। জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশ সেবায় রেখেছে অনন্য অবদান।

দেশের প্রতি আমাদের মমত্ববােধ ও চিরকৃতজ্ঞ চিত্তই এগিয়ে চলার পাথেয়। বাঙালির আত্মপরিচয় বিকাশের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে শতবর্ষ আগে আজকের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয়। করােনা সংকটের কারণে বাঙালির আত্মপরিচয় বিকাশের এই প্রাণকেন্দ্রের জন্মদিনটি বিপুল উচ্ছাস নিয়ে উদ্যাপন করতে পারছি না। সে জন্য তাে মনে। দুঃখ থাকারই কথা। একইভাবে আমরা দুঃখিত জাতির পিতার জন্মশতবর্ষটি আনন্দঘন পরিবেশে পালন করতে না পারায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও আমরা সেভাবে পালন করতে পারিনি। ভাগ্যিস, বঙ্গবন্ধুকন্যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আগেভাগে। ডিজিটাল প্রযুক্তির যে অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে বাংলাদেশে, তার কল্যাণে ঘরে বসেই এই তিনটিই ‘মাইলস্টোন’ অন্তত ভার্চুয়ালি পালন করছি।

নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎসভূমি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘আমার বাংলা, আমার কৃষ্টি, আমার সভ্যতা, আমার আকাশ, আমার বাতাস, আমার ইতিহাস। এই নিয়ে আমার বাংলার জাতীয়তাবাদ। আমার বাংলার সংগ্রাম, আমার বাংলার ঐতিহ্য এবং রক্ত নিয়ে আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ।’ (১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান বিষয়ে গণপরিষদে ভাষণ; দেখুন ড. এ এইচ খান, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণ, একাত্তর প্রকাশনী, ২০১১, পৃষ্ঠা-৯৭)। আর জাতীয়তাবাদের উত্তম চর্চা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অধিকাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত। আর এ স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কদের অধিকাংশ এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র।’ (রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শুভাগমন উপলক্ষে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্র, পৃষ্ঠা ৮১)।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ব বাংলায় মূলত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে ওঠে। কিন্তু হঠাৎ ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর এ অঞ্চলের উঠতি মধ্যবিত্তের মনে হতাশার জন্ম নেয়। সেই হতাশা প্রশমনের জন্য সৃষ্টি হলেও এখানকার মানুষের নবজাগরণ সৃষ্টির সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য ভূমিকার কথা অস্বীকারের কোনাে উপায় নেই। ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিলাে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাধীনভাবে বিশ্লেষণ অনুশীলন করে চিন্তা করতে শেখানাে। ১৯৪৭ সালের পর রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ ঘটতে থাকে একের। পর এক ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব গণআন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্দয় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়।

পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাতও হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তল্কালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিনদিন আগে ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ
কে ফজলুল হকসহ একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি। ওই বছরের ২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ব্যারিস্টার আর নাথানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপাের্ট এবং ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমােদিত হয়।

১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইনসভা পাস করে ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়। উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুল মতিন চৌধুরী, পদার্থবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া, নােবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কবি বুদ্ধদেব বসু, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমাম, কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, লেখক জাফর ইকবালসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং পরে দীর্ঘদিন এই শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকতা করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

তিনি তার এক নিবন্ধে লিখেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক প্রয়ােজনে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। জ্ঞানের চর্চা হয়েছে, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সমিতি, ছাত্রসংসদ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গঠনমূলক কাজে বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন যেনাে এই কাজগুলাে সেভাবে হচ্ছে না। এই শিক্ষাবিদ পরামর্শ দিয়ে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে হবে। তারা শিক্ষাদানের পাশাপাশি গবেষণা করবেন, প্রকাশনা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি জ্ঞানের প্রসার, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসারে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা উচ্চশিক্ষার সুযােগ পেয়েছে। ‘ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ গঠনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিলাে অগ্রগামী। মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনসহ প্রায় সব ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, অতীতের মতাে ভবিষ্যতেও এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতির আশাআহক্ষা পূরণে দেশ ও দেশের মানুষের পাশে থাকবে, অনুপ্রেরণা জোগাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !