সিন্ধু সভ্যতা | সিন্ধু সভ্যতার অবদান | রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা

Preparation BD
By -
0

সিন্ধু সভ্যতা : সিন্ধু নদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল বলে এই সভ্যতার নাম রাখা হয় সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতিকে অনেক সময়ে হরপ্পা সংস্কৃতি বা হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। এই সভ্যতার আবিষ্কার কাহিনি চমৎকার। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারাে শহরে উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি ছিল।

স্থানীয় লােকেরা বলত মরা মানুষের ঢিবি (মহেঞ্জোদারাে কথাটির মানেও তাই)। বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপধ্যায়ের নেতৃত্বে পুরাতত্ত্ব বিভাগের লােকেরা ঐ স্থানে বৌদ্ধস্কুপের ধ্বংসাবশেষ আছে ভেবে মাটি খুঁড়তে থাকেন। অপ্রত্যাশিতভাবে বেরিয়ে আসে তাম্রযুগের নিদর্শন। একই সময়ে ১৯২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে দয়ারাম সাহানীর প্রচেষ্টায় পাঞ্জাবের পশ্চিম দিকে মন্টোগােমারি জেলার হরপ্পা নামক স্থানেও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। জন মার্শালের নেতৃত্বে পুরাতত্ত্ব বিভাগ অনুসন্ধান চালিয়ে আরও বহু নিদর্শন আবিষ্কার করে।

ভৌগােলিক অবস্থান : উপমহাদেশের প্রাচীনতম সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি বিশাল এলাকা জুড়ে। মহেঞ্জোদারাে ও হরপ্পাতে এই সভ্যতার নিদর্শন সবচেয়ে বেশি আবিষ্কৃত হয়েছে। তা সত্ত্বেও ঐ সভ্যতা শুধু সিন্ধু অববাহিকা বা ঐ দুটি শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ, ভারতের পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাটের বিভিন্ন অংশে এই সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, পাঞ্জাব থেকে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভৌগােলিক এলাকা জুড়ে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। একক কাজ : ভারত ও পাকিস্তানের কোন কোন অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। অঞ্চলগুলাের আলাদা আলাদা তালিকা প্রস্তুত কর।

আরো পড়ুন : Current Affairs May 2021 PDF | কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স মে ২০২১ পিডিএফ

সময়কাল : সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ ও মনে করেন, অ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এ সভ্যতার উত্থান-পতনের কাল। আবার কোনাে * কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন, আর্য জাতির আক্রমণের ফলে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১৫০০ অথবা ১৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার অবসান ঘটে। তবে, মর্টিমার হুইলার মনে করেন, এই সভ্যতার সময়কাল হচ্ছে ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার জনগণের রাজনৈতিক জীবন ও শাসনপ্রণালি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। মহেঞ্জোদারাে ও হরপ্পার নগর বিন্যাস প্রায় একই রকম ছিল। এগুলাের ধ্বংসাবশেষ দেখে নিশ্চিতভাবে বােঝা যায় যে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী উঁচু ভিতের উপর শহরগুলাে নির্মাণ করা হয়েছিল। শহরগুলাের এক পাশে উঁচু ভিত্তির উপর একটি করে নগরদুর্গ নির্মাণ করা হতাে। চারদিক থাকত প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। নগরের শাসনকর্তারা নগর দুর্গে বসবাস করতেন।

প্রশাসনিক বাড়িঘরও দুর্গের মধ্যে ছিল। নগরের ছিল প্রবেশদ্বার। দুর্গ বা বিরাট অট্টালিকা দেখে মনে হয় একই ধরনের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে নগর দুটিতে প্রচলিত ছিল। এই প্রশাসন জনগণের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত। সিন্ধু সভ্যতার যুগে মানুষ সমাজবদ্ধ পরিবেশে বসবাস করত। সেখানে একক পরিবার পদ্ধতি চালু ছিল। সিন্ধু সভ্যতার যুগে সমাজে শ্রেণিবিভাগ ছিল। সব লােক সমান সুযােগ-সুবিধা পেত না। সমাজ ধনী ও দরিদ্র দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। কৃষকরা গ্রামে বসবাস করত ।

শহরে ধনী এবং শ্রমিকদের জন্য আলাদা-আলাদা বাসস্থানের নিদর্শন পাওয়া গেছে । পপাশাক-পরিচ্ছদের জন্য তারা মূলত সুতা ও পশম ব্যবহার করত। সিন্ধু সভ্যতার সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। নারীরা খুবই শৌখিন ছিল। তাদের প্রিয় অলঙ্কারের মধ্যে ছিল হার, আংটি, দুল, বিছা, বাজুবন্ধ, চুড়ি, বালা, পায়ের মল ইত্যাদি। তারা নকশা করা দীর্ঘ পােশাক পরত। পুরুষরাও অলঙ্কার ব্যবহার করত।

অর্থনৈতিক অবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিনির্ভর। তাছাড়াও অর্থনীতির আর একটি বড় দিক ছিল পশুপালন। কৃষি ও পশুপালনের পাশাপাশি মৃৎপাত্র নির্মাণ, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, অলঙ্কার নির্মাণ, পাথরের কাজ ইত্যাদিতেও তারা যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল। এই উন্নতমানের শিল্পপণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে সেখানকার বণিকরা বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যােগাযােগ রক্ষা করে চলত। বণিকদের সাথে আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, মধ্য এশিয়া, পারস্য, মেসােপটেমিয়া, দক্ষিণ ভারত, রাজপুতনা, গুজরাট প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যােগাযােগ ছিল।

আরো পড়ুন : মিশরীয় সভ্যতা | সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান | লিখনপদ্ধতি ও কাগজ আবিষ্কার

ধর্মীয় অবস্থা : সিন্ধু সভ্যতায় কোনাে মন্দির বা মঠের চিহ্ন পাওয়া যায়নি; যে কারণে তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব নয়। তবে, তাদের মধ্যে যে ধর্মবিশ্বাস ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মন্দির বা উপাসনা গৃহের অস্তিত্ব না থাকলেও স্থানে স্থানে অসংখ্য পােড়ামাটির নারীমূর্তি পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, তারা ঐ ধরনের দেবীমূর্তির পূজা করত । সিন্ধুবাসীর মধ্যে মাতৃপূজা খুব জনপ্রিয় ছিল। তাছাড়া তারা দেব-দেবী মনে করে বৃক্ষ, পাথর, সাপ এবং পশু-পাখির উপাসনাও করত। সিন্ধুবাসী পরলােকে বিশ্বাস করত । যে কারণে কবরে মৃতের ব্যবহার করা জিনিসপত্র ও অলঙ্কার রেখে দিত।

সিন্ধু সভ্যতার অবদান :

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলাের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতা। নিম্নে এই সভ্যতার অবদান আলােচনা করা হলাে।

নগর পরিকল্পনা : সিন্ধু সভ্যতার এলাকায় যেসব শহর আবিস্কৃত হয়েছে তার মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাে সবচেয়ে বড় শহর। ঘরবাড়ি সবই পােড়ামাটি বা রােদে পােড়ানাে ইট দিয়ে তৈরি। শহরগুলাের বাড়িঘরের নকশা থেকে সহজেই বােঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা যুগের অধিবাসীরা উন্নত নগরকেন্দ্রিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাের নগর পরিকল্পনা একই রকম ছিল।

নগরীর ভেতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। রাস্তাগুলাে ছিল সােজা। প্রত্যেকটি বাড়িতে খােলা জায়গা, কূপ ও স্নানাগার ছিল । জল নিষ্কাশনের জন্যে ছোেট নর্দমাগুলােকে মূল নর্দমার সাথে সংযুক্ত করা হতাে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হতাে। পথের ধারে ছিল সারিবদ্ধ ল্যাম্পপােস্ট।

পরিমাপ পদ্ধতি : সিন্ধু সভ্যতা যুগের অধিবাসীরা দ্রব্যের ওজন পরিমাপ করতে শিখেছিল। তাদের এই পরিমাপ পদ্ধতির আবিষ্কার সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে বিবেচিত। তারা বিভিন্ন দ্রব্য ওজনের জন্য নানা মাপের ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির বাটখারা ব্যবহার করত। দাগ কাটা স্কেল দিয়ে দৈর্ঘ্য মাপার পদ্ধতিও তাদের জানা ছিল।

শিল্প : সিন্ধু সভ্যতা যুগের অধিবাসীদের শিল্পবােধ সম্পর্কে আলােচনা করতে গেলে প্রথমেই মৃৎশিল্পের কথা বলতে হয়। তারা কুমারের চাকার ব্যবহার জানত এবং তার সাহায্যে সুন্দর মাটির পাত্র বানাতে পারত। পাত্রগুলাের গায়ে অনেক সময় সুন্দর সুন্দর নকশা আঁকা থাকত। তাঁতিরা বয়নশিল্পে পারদর্শী ছিল।

ধাতুর সাহায্যে আসবাবপত্র, অস্ত্র এবং অলঙ্কার তৈরি করা হতাে। তারা তামা ও টিনের মিশ্রণে ব্রোঞ্জ তৈরি করতে শিখেছিল । কারিগররা রুপা, তামা, ব্রোঞ্জ প্রভৃতি দ্বারা তৈজসপত্র তৈরি করত। তাছাড়া সােনা, রুপা, তামা, ইলাম ও ব্রোঞ্জ ইত্যাদি ধাতুর অলঙ্কার তৈরিতে তারা পারদর্শী ছিল। অলঙ্কারের মধ্যে আংটি, বালা, নাকফুল, গলার হার, কানের দুল, বাজুবন্ধ ইত্যাদি ছিল উল্লেখযােগ্য।

সিন্ধু সভ্যতা যুগের অধিবাসীরা লােহার ব্যবহার জানত না। ধাতু ছাড়া দামি পাথরের সাহায্যে অলঙ্কার তৈরি করতেও তারা পারত । হাতির দাঁতসহ অন্যান্য হস্তশিল্পেরও দক্ষ কারিগর ছিল ।

স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : সিন্ধু সভ্যতা যুগের অধিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন রেখে গেছে। সেখানে দুই কক্ষ থেকে পঁচিশ কক্ষের বাড়ির সন্ধানও পাওয়া গেছে। আবার কোথাও দুই-তিন তলা ঘরের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়েছে। মহেঞ্জোদারাের স্থাপত্যের উল্লেখযােগ্য উদাহরণ হলাে বৃহৎ মিলনায়তন’ যা ৮০ ফুট জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছিল।

আরো পড়ুন : ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারণা | ইতিহাসের উপাদান | ইতিহাসের প্রকারভেদ

তাছাড়া বিশাল এক প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া গেছে। হরপ্পাতে বিরাট আকারের শস্যাগারও পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদারােতে একটি বৃহৎ স্নানাগার’-এর নিদর্শন পাওয়া গেছে যার মাঝখানে বিশাল চৌবাচ্চাটি ছিল সাঁতার কাটার উপযােগী।

ভাস্কর্যশিল্পেও সিন্ধুসভ্য যুগের অধিবাসীদের দক্ষতা ছিল। পাথরে খােদিত ভাস্কর্যের সংখ্যা কম হলেও সেগুলাের শৈল্পিক ও কারিগরি দক্ষতা ছিল উল্লেখ করার মতাে। এ যুগে মােট ১৩টি ভাস্কর্য মূর্তি পাওয়া গেছে। চুনাপাথরে তৈরি একটি মূর্তির মাথা পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদারােতে পাওয়া গেছে নৃত্যরত একটি নারীমূর্তি।

এছাড়া মাটির তৈরি ছােট ছােট মানুষ আর পমূর্তিও পাওয়া গেছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারােতে প্রাপ্ত উল্লেখযােগ্য শিল্পকর্ম হলাে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২৫০০ সিল। ধর্মীয় ও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রয়ােজনে এগুলাে ব্যবহৃত হতাে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !